আমাদের বিশ্বানাথ দর্শনের গল্প

বিশ্বনাথ  দর্শনের  ইচ্ছে  আমার  অনেক দিনের। অবশেষে  বিশ্বনাথের  কৃপা  হলো।  ২২শে   জুন  ২০২৩  রাত  ১০ :৩০ এ  কলকাতা স্টেশন  থেকে  শব্দভেদী  এক্সপ্রেসে চেপে  রওয়ানা  হলাম  বারানসি  স্টেশনে |

Varanasi Tour

ট্রেন  জার্নি  ভালো  ছিল ,সারারাত  ট্রেনে  ভালো ঘুম হয়েছে,কোনো অসুবিধা হয়নি । পরদিন  সকালে, ব্রেকফাস্ট IRCTCR (Indian Railway Catering and Tourism Corporation) থেকে অর্ডার করে ,ট্রেনে সেরে  নিলাম। ঠিক  ১০ :৩০  তে  আমরা  বারানসি স্টেশনে নেমে  পড়লাম। মালপত্র  নিয়ে  স্টেশন  ছেড়ে,  অটো  নিয়ে হোটেলের রাস্তা ধরলাম। সকাল ১১ টায়  হোটেলে  পৌঁছে গেলাম ।

আমার  শশুর,শাশুড়ি ও ননদ , এক  দিন  আগে  হোটেলে  পৌঁছে  গেছিলেন। শশুর-শাশুড়ি সকালে,বিশ্বনাথ  দর্শনের খোঁজ খবরে বেরিয়ে, আমাদের সবার জন্য গরম  কচুরি আর আলু তরকারি নিয়ে ফিরলেন। গিয়ে মেয়ের জন্য হোটেলে খিচুড়ি অর্ডার করে ,ফ্রেশ হয়ে সবাই একসাথে কচুরি আর চা খেলাম। মেয়ে খিচুড়ি খেয়ে নিলে, স্নান সেরে , ঘন্টা  দুয়েক  ঘুমিয়ে নিলাম |

ঘুম  থেকে  উঠে,  লাঞ্চ  সেরে , ছুটলাম দশাস্বমেধ  ঘাট। উদ্দেশ্য ,সন্ধ্যায় গঙ্গা  আরতি  দেখবো | একটু বিকেল বেঁচে ছিল ,তাই নৌকা  ঠিক  হলো , প্রথমে  গঙ্গা  ঘুরে  বেড়াবো  আর সন্ধ্যায় নৌকায়  বসে  আরতি  দেখবো | গঙ্গার  জল  এখানে  কালো |

নৌকা  ছুটলো কালো গঙ্গার বুক ভেসে  | নৌকায় ভেসে ভাবছিলাম , এত  প্রাচীন  ১টা  শহর ,কি  করে  এখনো  ভক্ত  বিশ্বাস  ভক্তিতে  অতটা  পরিপূর্ণ !!! কত অলৌকিক গল্প প্রচলিত আছে ,এই  কাশী ধামকে ঘিরে;সত্যিই কি সব সত্য !!!

কাশী গঙ্গার একপাশে ঘাটের সারি ,অন্যপাশে বালির চর । বালির চরে ,উটের পিঠে লোক চড়তে দেখা গেলো। তাঁবু টানানো ও দেখতে পেলাম। এই তাঁবুগুলু নাকি ভাড়া দেয়া হয়।

মণিকর্ণিকা ঘাটে মৃত দেহ পোড়ানো দাউ দাউ লেলিহান শিখা দূরে নৌকাতে বসে দেখতে লাগলাম।  মনে হলো ,আহা!! আমার এই দেহখানি , এমনি একদিন জ্বলে পুড়ে হবে ছাই, তবে কিসের এত বড়াই ভাই !!!

নৌকায় বসে এসব দার্শনিক ভাবনা ভাবতে ভাবতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। ঘাটে আরতি শুরু হওয়ার লক্ষণ দেখতে পেলাম। পুরুহিতরা বোরো কাঁসার ছাতার নিচে বসে আরতি উপাচার সাজিয়ে নিচ্ছিলেন । স্পিকার এ গঙ্গা মাতার গান ও মন্ত্র বাজছিলো। ঘাট প্রায় লক্ষ লোকে পরিপূর্ণ।

আমাদেরকে নৌকার মাঝি , আরেকটা নৌকাতে উঠিয়ে দিলো বসে আরতি দেখার জন্য। কোনো ভিড় নেই নৌকাতে। খুব আরামে ,গঙ্গাবক্ষে বসে নানাবিধ উপাচারে আরতি দর্শনের সৌভাগ্য অবশেষে  হলো। ওই মুহূর্তটা  দারুন উপভোগ্য। ঠিক কেমন যেন ১টা স্বর্গীয় পরিবেশ। এত লোক কিন্তু সবাই চুপ। কোনো হট্টগোল নেই । সবাই চুপ করে মন্ত্র শুনছে আর আরতি দেখছে। অনেক্ষন চললো আরতি।

আরতি শেষে প্রণাম করে ,প্রদীপ ভাসিয়ে, ঘেমে নেয়ে ডাব খেয়ে , হোটেলে ফিরলাম হেঁটে হেঁটে।

হোটেলে ফিরে ,কাশীধামের বিখ্যাত দই ও ক্ষীর খেলাম মন ভরে।  স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। 

পরের দিন বিশ্বনাথ দর্শনের ইচ্ছা। রাতের খাবার ফ্রাইড রাইস , আলুমটর,ডাল তারকা অর্ডার  করে ফ্রেশ হয়ে ,সবাই মিলে গল্পে মশগুল হলাম  | খাবার এলো এবং খেয়ে রাত ১১টার মধ্যে  ঘুমিয়ে পড়লাম | রাত্র  আড়াইটা  বাজে স্নান  করে  তৈরী হয়ে  গেলাম  বিশ্বনাথ  দর্শনের  জন্য  | ইন্কাকে ঘুমের  মধ্যে  স্নান  করিয়ে  তৈরী করে দিলাম  |

রাত ৩:৪৫ মিনিটে ,টোটো  নিয়ে  বেরিয়ে  গেলাম  সবাই  বিশ্বনাথ  মন্দিরের  উদ্দেশ্যে | আগে  থেকেই  কথা  বলা  ছিল;  সে  অনুযায়ী টোকেন কেটে ,  সবাই মোবাইল  ফোন  জমা  রেখে  পূজারীকে  নিয়ে  চললাম  বিশ্বনাথ  দর্শনে |লাইন  ধরে  সিকিউরিটি  চেক  ও  জুতা  জমা  দিয়ে  দর্শনের  লাইন  দিলাম |কেউ বলে  এটা  ভগবান  শিবের  প্রথম  জ্যোতির্লিঙ্গ আবার কেউ বলে সোমনাথ |সে যা ই  হউক ,শিব  স্বয়ম্ভূ এখানে | এমন ব্রাম্মমুহূর্তে নিজেকে এমন জায়গায় আবিষ্কার করে মন আনন্দে ভরে উঠলো।

শিব স্তুতি করতে লাগলাম মনে মনে। সবাই করছে। গোটা পরিবেশটাই শিব বন্দনায় মুখরিত। মেয়ে কোলে ঘুমাচ্ছিলো ,মন্দিরের দরজার সামনে আসতেই ও জেগে গেল। প্রচন্ড ধাক্কা সামলে, মেয়ে কোলে, স্বয়ম্ভূ  বিশ্বনাথ  কে  স্পর্শ করলাম। এত ভালো লাগছিলো আর এত আনন্দ হচ্ছিলো সে বর্ণনাতীত। ছুঁয়ে বসে থাকতে মন চাইছিলো। সে উপায়তো নেই। পেছনে অসংখ্য পুণ্যার্থী। সবাই স্পর্শ করতে চায়। উঠে বেরিয়ে পূজা যেখানে দেব সেখানে গেলাম। পূজারী অপেক্ষা করতে বললো। কিছুক্ষন পর উনি ৫টা পূজার ডালা তৈরী করে নিয়ে এসে আমাদের দিয়ে পূজা শুরু করে দিলেন।

পুরোহিত খুব সুন্দর করে পূজা করিয়েছেন | মনটা  আনন্দে ভরে গেলো | এমন  ব্রাম্মমুহূর্তে  বিশ্বনাথের  দর্শন  আর  পূজা,  অশান্ত  মনটাকে  একদম  শান্ত  করে , শান্তিতে  ভরিয়ে  তুললো |  পূজা শেষে, প্রাসাদ নিয়ে ,মন্দির চত্বর ঘুরে দেখলাম।

মন্দির চত্বরে ,একজন পঁচাত্তর বছর বয়সী সাধুর সাথে দেখা হলো। আশীর্বাদ নিলাম। তিনি আবার আমার মেয়েকে কুড়কুড়ে খাবি বলে ,১০ রুপি দিলেন।

অন্নপূর্ণা  মন্দির ,হনুমান মন্দির ,গনেশ মন্দির দেখে  প্রাসাদ সংগ্রহ করে ,বেরিয়ে গেলাম মন্দির  থেকে |

টোকেন জমা দিয়ে,জিনিসপত্র নিয়ে  টোটো  করে  হোটেলে চললাম | হোটেলের  সামনে  টোটো  থেকে  নেমে  চা  খেলাম |চা  খেয়ে  হোটেলে ফিরে দেখি , ৬ :১৫  বাজে | তারপর লম্বা ১টা ঘুম  দিলাম | সকাল ১ ১:৩০  এর দিকে উঠে ,রামকৃষ্ণ মিশনে  গেলাম  প্রাসাদ  খেতে।

কুপন  আগে  কাটা  ছিল | প্রাসাদ  খেয়ে  পরিচিত  ১জনের  সাথে  দেখা  করে  হোটেলে  ফিরলাম |৩০  মিনিট  রেস্ট  করে , বেনারসি  কেনার  উদ্দেশ্যে  বের হলাম  |বেনারসি  কিনে  ফিরলাম ,সন্ধ্যা  ও   নামলো |ফিরে  দীনা চাট  এর  চাট  খেলাম। রাবড়ি  খেলাম ,দই  খেলাম ,পান  খেলাম |সবগুলো মনে  রাখার  মতো  এবং  অতি  সুস্বাদু |   

রাতে হোটেল ডাইনিং এ নিরামিষ পার্টি সেরে ,রাত ১২ টার  মধ্যে  ঘুম |পরদিন সকাল  ১০টায়  টোটো  নিয়ে অন্যান্য  মন্দির  দর্শনে  বের হলাম। 

হনুমান  মন্দির ,মাতা  দূর্গা  মন্দির,রাম  মন্দির ,মহাদেব  মন্দির  দেখে  প্রাসাদ  খেয়ে  হোটেলে  ফিরলাম | দুপুর ১টায়  চেকআউট  টাইম  আমাদের |চেকআউট  করে , হোটেল  ডাইনিং  লাঞ্চ  সেরে, গেস্ট রুমে রেস্ট করে, বিকেল ৪ : ১৫ তে  বেরিয়ে  গেলাম  লাল  বাহাদুর  শাস্ত্রী  এয়ারপোর্ট  এর উদ্দেশ্যে |

সন্ধে  ৭টায়  আমাদের  ফ্লাইট | এয়ারপোর্ট  পৌঁছে  সিকিউরিটি  করে , কফি  খেতে  খেতে  ফ্লাইট  এর  টাইম  গুনছিলাম |৩০ মিনিট  দেরি  ছিল |

কলকাতা  এয়ারপোর্ট  পৌঁছাতে  ৯টা  বেজে  গেলো।

বাসায়  ফিরতে  ফিরতে  রাত  ১০টা |

ফিরে ভাবলাম  ভোলানাথ , দুটো দিন  খুব  ভালো  রেখেছিলেন | বার  বার  চোখে  ও মনে ,  উঁকি  দিচ্ছিলেন,  স্বায়ম্ভূ  বিশ্বনাথ |


Disclaimer: The information provided on this blog is for general informational purposes only. It should not be considered legal or financial advice. The views expressed on this blog are solely those of the author and do not necessarily represent the views of any affiliated organizations or companies. The author is not liable for any errors or omissions in the information provided, nor for any losses, injuries, or damages that may result from the use of this information. Readers are advised to seek professional advice before making any decisions based on the information provided on this blog.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *