আনন্দ
সুকুমার রায়
যে আনন্দ ফুলের বাসে,
যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়,
যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দ বাতাস বহে,
যে আনন্দ সাগরজলে,
যে আনন্দ ধুলির কণায়,
যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দ আকাশ ভরা,
যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে,
যে আনন্দ রক্তধারায়
সে আনন্দ মধুর হয়ে
তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত
থাকুক তব জীবন ভরি।
ঠিকানা
সুকুমার রায়
আরে আরে জগমোহন- এসো, এসো, এসো-
বলতে পার কোথায় থাকে আদ্যানাথের মেসো?
আদ্যানাথের নাম শোননি? খগেনকে তো চেনো?
শ্যাম বাগ্চি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো।
শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন, তার যে বাড়ীওলা-
(কি যেন নাম ভুলে গেছি), তারই মামার শালা;
তারই পিশের খুড়তুতো ভাই আদ্যানাথের মেশো-
লক্ষ্মী দাদা, ঠিকানা তার একটু জেনে এসো।
ঠিকানা চাও? বলছি শোন; আমড়াতলার মোড়ে
তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে তারি একটা ধ’রে,
চলবে সিধে নাকবরাবর ডানদিকে চোখ রেখে;
চল্তে চল্তে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে।
দেখ্বে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে পথ গিয়েছে কত,
তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধার মত।
তারপরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে,
ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে।
তবেই আবার পড়বে এসে আমড়াতলার মোড়ে-
তারপরে যাও যেথায় খুশী- জ্বালিও নাকো মোরে।
নিঃস্বার্থ
সুকুমার রায়
গোপালটা কি হিংসুটে মা! খাবার দিলেম ভাগ করে,
বল্লে নাকো মুখেও কিছু, ফেল্লে ছুঁড়ে রাগ করে।
জ্যেঠাইমা যে মেঠাই দিলেন, ‘দুই ভায়েতে খাও বলে’−
দশটি ছিল, একটি তাহার চাখতে দিলেম ফাও বলে,
আর যে নটি, ভাগ করে তায় তিনটে দিলেম গোপালকে−
তবুও কেবল হ্যাংলা ছেলে আমার ভাগেই চোখ রাখে।
বুঝিয়ে বলি, কাঁদিস কেন? তুই যে নেহাৎ কনিষ্ঠ,
বয়স বুঝে, সামলে খাবি, তা নইলে হয় অনিষ্ট।
তিনটি বছর তফাৎ মোদের, জ্যায়দা হিসাব গুণতি তাই,
মোদ্দা আমার ছয়খানি হয়, তিন বছরে তিনটি পাই,
তাও মানে না কেবল কাঁদে, স্বার্থপরের শয়তানি,
শেষটা আমার মেঠাইগুলো খেতেই হলো সবখানি।
ভয় পেয়োনা
সুকুমার রায়
ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না-
সত্যি বলছি কুস্তি ক’রে তোমার সঙ্গে পারব না।
মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!
মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না-
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?
এস এস গর্তে এস, বাস ক’রে যাও চারটি দিন,
আদর ক’রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন।
হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না?
মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমায় লাগবে না।
অভয় দিচ্ছি, শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!
আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে-
সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।
প্যাঁচা আর প্যাঁচানী
সুকুমার রায়
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী,
খাসা তোর চ্যাঁচানি
শুনে শুনে আন্মন
নাচে মোর প্রাণমন!
মাজা-গলা চাঁচা-সুর
আহলাদে ভরপুর!
গলা-চেরা ধমকে
গাছ পালা চমকে,
সুরে সুরে কত প্যাঁচ
গিট্কিরি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্!
যত ভয় যত দুখ
দুরু দুরু ধুক্ ধুক্,
তোর গানে পেঁচি রে
সব ভুলে গেছি রে,
চাঁদমুখে মিঠে গান
শুনে ঝরে দু’নয়ান।
গল্প বলা
সুকুমার রায়
“এক যে রাজা’– “থাম না দাদা,
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা।”
“তার যে মাতুল”- “মাতুল কি সে?
সবাই জানে সে তার পিসে।”
“তার ছিল এক ছাগল ছানা”
“ছাগলের কি গজায় ডানা?”
“একদিন তার ছাতের ‘পরে” –
“ছাত কোথা হে টিনের ঘরে?”
“বাগানের এক উড়ে মালী”–
“মালি নয়ত? মেহের আলি”
“মনের সাধে গাইছে বেহাগ”—
“বেহাগ তাে নয় ? বসন্ত রাগ।”
“থও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি”—
“আচ্ছা বল চুপ করেছি।”
“এমন সময় বিছনা ছেড়ে,
হঠাৎ মামা আসল তেড়ে,
ধরল সে তার ঝুঁটির গোড়া-
“কোথায় ঝুঁটি ? টাক যে ভরা।”
“হােক না টেকো তাের তাতে কি?
লক্ষ্মীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি!
ধরব ঠেসে টুঁটির ‘পরে,
পিটব তােমায় মুণ্ডু ধরে–
কথার উপর কেবল কথা,
এখন বাপু পালাও কোথা?”
মনের মতন
সুকুমার রায়
কান্না হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি,
বৃদ্ধ বছর উধাও হ’ল ভূতের মুলুক খুঁজি।
নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে,
বল্ দেখি মন মনের মতন কি দিবি তুই তারে?
আর কি দিব?- মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ,
সুখের মাঝে দুখের মাঝে আনন্দময় গান।
সৎপাত্র
সুকুমার রায়
শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে-
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে?
জানতে চাও সে কেমন ছেলে?
মন্দ নয় সে পাত্র ভালো
রঙ যদিও বেজায় কালো;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক পেঁচার মতন;
বিদ্যে বুদ্ধি? বলছি মশাই-
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়!
উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল হয়ে থামল শেষে।
বিষয় আশয়? গরীব বেজায়-
কষ্টে-সৃষ্টে দিন চলে যায়।
মানুষ তো নয় ভাইগুলো তার-
একটা পাগল একটা গোঁয়ার;
আরেকটি সে তৈরী ছেলে,
জাল করে নোট গেছেন জেলে।
কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়
যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায়।
গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে।
কিন্তু তারা উচ্চ ঘর,
কংসরাজের বংশধর!
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের
কি যেন হয় গঙ্গারামের।-
যহোক, এবার পাত্র পেলে,
এমন কি আর মন্দ ছেলে?
জীবনের হিসাব
সুকুমার রায়
বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ”বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ”সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।”
খানিক বাদে কহেন বাবু, ”বলতো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, ”আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, ”এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”
আবার ভেবে কহেন বাবু, ” বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, ”বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, ” একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!’