দার্জিলিং ভ্রমণ ||দার্জিলিং এর স্মৃতিলিপি (দ্বিতীয় খন্ড )

গ্লেনারিজ  থেকে  বের  হয়ে  কিছু  দোকানপাট  ঘুরে  টুকটাক  কেনাকাটা  করলাম |ফেরার  পথে  দার্জিলিং ক্লক  টাওয়ার দেখলাম | বেশ  ভালো  লাগছিলো ,এতো  পুরোনো  ১টা  জিনিস  দেখে|তারপর  উঁচু  পাহাড়  বেয়ে  আমাদের  গেস্ট  হাউসে ফিরলাম |ঘরে  ফিরে, ভীষণ  হাঁপাচ্ছিলাম  দুজনে |কিছুক্ষন  পর  ফ্রেশ  হয়ে  আবার  কাঞ্চনজঙ্ঘা  দেখতে  বসলাম|জমিয়ে  আড্ডা  চলছিল আমাদের|

গ্লেনারিজ এর খাবার  খাওয়ার  পর ,আর  দুপুরের  খাবার  নিয়ে  ভাবতে  হলোনা| বিকেলে  একটু  ঘুমিয়ে  নিলাম|রাতে  কি  খাবো আলোচনা করে  অর্ডার  দিয়ে গেলাম|আর  বললাম  রাতে  আমাদের অর্ডারটা হবে আপনার সর্বশেষ  ডেলিভারি |এখানে  সবাই “Early to bed ,early to rise” প্রবাদ  খুব  মেনে চলে|আমাদের  মতো  রাত  জাগা  লোকেরা ও  মানতে  বাধ্য|

সন্ধ্যার  পর   আবার  হেঁটে  হেঁটে  বের হলাম  রাতের  দার্জিলিং  শহরকে  দেখতে|ইশ ! কি  অসাধারণ  দেখতে ! নিকষ  কালো  অন্ধকারে ,বিস্তীর্ণ  এলাকা  জুড়ে  ঘরবাড়ির  আলোকসজ্জাগুলু,  কি  অপূর্ব  লাগছিলো  দেখতে|চৌরাস্তাতে মোমো খেলাম| চা  পান করলাম| এদিক  ওদিক দেখতে দেখতে, রাত ৯টা বেজে গেলো|দোকান পাট  বন্ধ হতে থাকলো | বাতিগুলো ও নিভে যেতে থাকলো |রাত  ৯টা থেকে  ৯:৩০টার  মধ্যে  সব  দোকানপাট  বন্ধ  হয়ে  গেলো  এবং  লোকজন  কমে  যেতে  থাকলো| আমরা  ও  গেস্ট হাউসের রাস্তা ধরলাম|উঁচু  পাহাড়  দিয়ে  হেঁটে  ফিরতে  দেখলাম,  স্থানীয়  লোকেরা  ঘুমিয়ে  পড়েছে|নীরব  নিঃস্তব্দ  রাস্তা  দিয়ে  আমরা  দুজনে  হাত  ধরে  হেঁটে  হেঁটে  ফিরছিলাম|খুব  ঠান্ডা  লাগছিলো , সাথে  এত  শুনশান  নীরবতা  ভালো  ও  লাগছিলো|৯ :৪৫  বাজে  আমরা  ঘরে  ফিরলাম  এবং  সাথে  সাথে  ই   রাতের  খাবার  দিয়ে  গেলো | ফ্রেশ  হয়ে,  প্রয়োজনীয়  ফোন  সেরে,  রাতের  খাবার  খেয়ে  ঘুমিয়ে  পরলাম|

পরদিন  ভোরবেলা  ঘুম  ভাঙলো|ঝটপট  উঠে  পরলাম  কাঞ্চনজঙ্ঘা  দেখতে|আবহাওয়া মেঘাছন্ন  হওয়ায় আজ  আর দেখলাম  না|মনটা  খারাপ  হয়ে  গেলো|তা ও  সকাল  ৯টা  পর্যন্ত,  অনেকবার  উঁকিঝুঁকি দিলাম  দেখতে,  কিন্তু  প্রতিবার নিরাশ  হতে  হলো |চা, বিস্কিট খেয়ে  সকাল  ১০টা  নাগাদ  বেরিয়ে কুঙ্গা  রেস্টুরেন্ট  এ  গেলাম |এখানে  তিব্বতিয়ান  খাবার পাওয়া  যায় |আমরা  মোমস,থুকপা আর  চা  খেয়েছি |খাবার  খুব  সুস্বাদু  ছিল |

কুঙ্গাতে  খাওয়া  শেষ  করে  আমরা  গেলাম  মহাকাল  মন্দিরে|দীর্ঘ  আঁকাবাঁকা  পথ  পেরিয়ে  অবশেষে  মন্দির  প্রাঙ্গনে  পৌঁছালাম|দেখলাম  মহাকাল  এবং  বুদ্ধ  একসাথে  পূজিত  হচ্ছেন|মহাকাল  এর  পাশে  হিন্দু  পুরোহিত  আর  বুদ্ধের পাশে  বৌদ্ধিস্ট  সন্ন্যাসী| হিন্দুরা  হিন্দু  পুরোহিতের কাছে  যাচ্ছেন ,বৌদ্ধরা  যাচ্ছেন  বৌদ্ধিস্ট  সন্ন্যাসীর কাছে|আমরা  পুজো  দিলাম ,ঘুরে  দেখলাম,  হিন্দু  ধর্মের আরও  অনেক  দেবদেবী  আছেন  এই  মন্দিরে |বেশ   ভালো  সময়  কাটালাম  মন্দিরে|

তারপর  আমরা  হাঁটতে  শুরু  করলাম  দার্জিলিং  স্টেশনের  উদ্দেশ্যে|ইচ্ছে  দার্জিলিং  থেকে  ঘুম  স্টেশন  ঘুরে  আশা  টয়  ট্রেনে  চড়ে|এই   টয়  ট্রেন   ইউনেস্কো  ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ  স্বীকৃতি  পেয়েছে  ১৯৯৯ সালে |অনলাইন এ টয়  ট্রেন  এর  টিকিট   অগ্রিম কাটা  ছিল  ১৫দিন  আগে  থেকে |দুপুর  ২টা  বাজে  ছিল  ট্রেন |আমরা  ১ :৪৫  নাগাদ  পৌঁছে  গেলাম  এবং  ট্রেনে  চড়ে  বসলাম|এটা  ছিল আমাদের  প্রথম  দার্জিলিং  হিমালয়ান  রেলওয়েতে,  রেল  ভ্রমণ | আমার  দারুন  লাগছিলো|আসার  আগে  থেকেই  খুব  উত্তেজনা  ছিল , টয়  ট্রেন  নিয়ে|আমাদের  ট্রেনটা  কয়লা  থেকে  উৎপাদিত তাপ দিয়ে  চলবে |ভাবতেই  কেমন  ৮০বছর  পিছনে  চলে  গেছি  লাগলো | আর  আমরা  যে  টয়  ট্রেনটা  তে  চড়েছি  শুনলাম  সেটার  ইঞ্জিন  নাকি  ব্রিটিশরা  নিয়ে  এসেছিলো |

ট্রেন  ছাড়লো  ঘুম  স্টেশন  এর  উদ্দেশ্যে  ঠিক  ২টা  বাজে|ধুঁয়া  উড়িয়ে  এঁকে  বেঁকে  ছুটে  চললো  পাহাড়  বেয়ে |হর্নটা বেশিই একটু  অন্যরকম |এরকম হর্ন আগে শুনা হয়নি|ট্রেনের  ছাদের  কাঁচ  দিয়ে  দেখলাম নীল  আকাশ  আর  দুপাশের  জানালার  কাঁচ  দিয়ে  নানারকম  ফুলের গাছ |অন্য  আরও  গাছ , ঘরবাড়ি  দেখছিলাম |সবাই  যেন  ছুটে  লুকিয়ে  যাচ্ছিলো |কিছুক্ষন  পর  ট্রেনটা  মিনিট  দশেক  থামলো , জল  নেয়ার  জন্য এবং  জল নিয়ে আবার  ছুটলো|ট্রেনটা  কিন্তু অত বড় না |২টা  কামড়া যাত্রীদের  জন্য  আর  ১টা  ড্রাইভারদের  জন্য |ঠিক  যেন  খেলনা  ট্রেন |একবার  তো  কিছু  গাড়ি  উঠে  গেছিলো,  ট্রেনের লাইনে |আমি  তো  ভয়  পেয়ে  গেলাম |না,দেখি , ট্রেন  থেমে  গেলো , গাড়ি  লাইনের  উপর  দেখে |গাড়িগুলো  সরলো ,ট্রেন  আবার  ছুটলো |পরবর্তী  বিরতি  নিলো  বাতাসিয়া  লুপ  এ |ট্রেন  থেকে  নামলাম ,একটু  ঘুরে  দেখলাম  ও  কিছু  ছবি  তুললাম |বেশ  লাগছিলো  জায়গাটা |তারপর  গার্ড  বাঁশি বাজালো , আমরাও  ট্রেনে  উঠে  পড়লাম |এবার,  আবার  ট্রেন  ছুটলো  ঘুম  স্টেশন  এর  দিকে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে|

ঘুম  ভারতের  সব  থেকে  উঁচু  রেল  স্টেশন |ঘুম  স্টেশন  এ  পৌঁছালাম|ট্রেন  থেকে  নেমে দেখলাম ,টয় ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরাচ্ছে |ওটা এমনি ট্রেনের মতোই |ইঞ্জিনটাকে আলাদা করে ,ইঞ্জিন ঘুরে এসে বিপরীত দিকে লেগে যায়| তারপর  ঘুম  যাদুঘর ঘুরতে  গেলাম |ওখানে  রেল এর অনেক  আগের  কলকব্জা,রেল  লাইনের  পাত ,টেলিফোন ,ইউনেস্কো  ওয়ার্ল্ড  হেরিটেজ  সার্টিফিকেট  ইত্যাদি আছে |এতো পুরোনো জিনিস দেখতে ভালো লাগছিলো আমার|জাদুঘর দেখে, বেরিয়ে , স্টেশন  এ  এক  কাপ  চা  খেলাম|মিনিট  কুড়ি  ঘুম  স্টেশন  এ  কাটানোর  পর,  ফের  ট্রেনে  চড়ে  বসলাম | এবার যাত্রা দার্জিলিং  স্টেশন  অভিমুখে|মিনিট  পাঁচেক  পর  ট্রেন   চলতে  লাগলো |ঘন্টা খানেক এর মধ্যে  ,পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং  স্টেশন| স্টেশনে  নেমে , হেঁটে  রওয়ানা  হলাম  গেস্ট হাউসে |সূর্যাস্তের  আগে  ঘরে  ফিরে এলাম|ঘরে  এসে  সূর্যাস্ত  দেখলাম |একটা  গাছ ,যেটাতে   কোনো  পাতা  নেই|সেই গাছটার  পেছন  দিয়ে , সূর্যটা  টুপ্  করে  পাহাড়ে  ডুব  দেয় |এই ব্যাপারটা দেখতে ,মনে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে | এই  মুহূর্তটা  চিরঞ্জীব রুমে বসে, জানালা দিয়ে বেশ উপভোগ করলো |

সন্ধ্যার পর, চা  খেয়ে, রাতের  খাবার  অর্ডার  করে  আমরা  বের হলাম চৌরাস্তার দিকে|চৌরাস্তায় পৌঁছে  ,বসলাম  কিছুক্ষন|টুকিটাকি  কেনাকাটা  সেরে নিলাম|স্যুপ  খেয়ে রাত  ৯টা  ৩০মিনিটে  ঘরে  ফিরলাম|ফ্রেশ  হয়ে কিছুক্ষন আড্ডা  দিলাম|তারপর , রাতের  খাবার  খেয়ে ঘুমোতে গেলাম |পরদিন  ঘুম  ভাঙলো  ভোরে ,কাঞ্চনজংঘা  দেখার  লোভে ,কিন্তু আজও  মেঘে  ঢাকা |সকাল ৮টা  পর্যন্ত  অনেকবার   উঁকিঝুঁকি  দিলাম|যদিও প্রতিবার ই  দেখতে  না  পেয়ে  ব্যথিত  হলাম|উঠে  প্যাকিং ও  সেরে  নিয়েছিলাম  কারণ  আজ  আমরা  বেরিয়ে  যাচ্ছি  মিরিখ|সকাল ৮ :৩০ মিনিট নাগাদ  বেরিয়ে,  প্রাতরাশ  করে  মিরিখ  যাওয়ার  গাড়ি   নিয়ে  গেস্ট  হাউসে   ফিরলাম|মিরিখ  যাওয়ার  গাড়িটা,  আমরা  ১দিন  আগে ই বুক  করে  রেখেছিলাম|সকাল ১০ :৩০ মিনিটে,  গেস্ট  হাউসে  থেকে  চেক আউট  করে  বেরিয়ে  পড়লাম,গন্তব্য মিরিখ|

দার্জিলিং  শহর  ছেড়ে  আমরা  যখন  মিরিখ  যাওয়ার  রাস্তা  ধরলাম ,রাস্তার  দুপাশের  সৌন্দর্য্যে চোখ জুড়িয়ে গেলো|দুপাশে  পাহাড় ঘেঁষে পাইন  গাছের  সারি  আর  উঁচু  নিচু  আঁকাবাঁকা  পাহাড়ি  রাস্তা |গাড়ির  চালক  বলছিলো ,এখানে  এমনো  অনেক  জায়গা  আছে ,কখনোই  রোদ  লাগেনা |চলতে চলতে থামলাম আমরা ,নেপাল ভারত সীমান্তের কাছাকাছি  একটা জায়গায় |আমরা ওখানে ওয়েই ওয়েই,আলুর লাল রঙের  পাতলা ঝোল ভোজিয়া দিয়ে(নামটা ভুলে গেছি ) খেলাম|বেশ  ভালো লাগলো  জায়গাটা |

আমরা  যে  পাহাড়টাতে  দাঁড়িয়েছিলাম , সেটা  ভারত সীমান্তে |চোখের  সামনে  যে  পাহাড়টা  দাঁড়িয়েছিল  সেটা  নেপাল  সীমান্তে|এক  কথায়  সব  কিছু  চোখ  জুড়ানো  সুন্দর|এখান  থেকে  বেরিয়ে  গেলাম  মিরিখ  সৌরীনে রিসোর্ট  এর  উদ্দেশ্যে|রাস্তায়  রেখে  আসলাম  সান্দাকফু   যাওয়ার  রাস্তা |সান্দাকফু  মাত্র ২০ কি:মি: দূরে ছিল |সুখিয়া  বাজারের  লোকজন  দেখলাম  ভারী  শীতের  জামা গায়ে|চালক বললো, সান্দাকফু  যেতে হলে ,সুখিয়া বাজার থেকে গাড়ি নিতে হবে|সান্দাকফুতে নাকি তখন বরফ পড়ছিলো |সান্দাকফু  যাওয়ার  সাহস  আর  হলোনা |কারণ, পরিকল্পনা ছিল না আগে থেকে আর ঠান্ডায় কাবু  হয়ে  তৎক্ষণাৎ উদ্দম নেয়ার সাহস হলোনা |সৌরীনে রিসোর্ট এর রাস্তায় চলতে থাকলাম|রিসোর্ট  এ  পৌঁছাতে ২টা  বেজে  গেলো |

দার্জিলিং এর স্মৃতিলিপি(প্রথম খন্ড)


Disclaimer: The information provided on this blog is for general informational purposes only. It should not be considered legal or financial advice. The views expressed on this blog are solely those of the author and do not necessarily represent the views of any affiliated organizations or companies. The author is not liable for any errors or omissions in the information provided, nor for any losses, injuries, or damages that may result from the use of this information. Readers are advised to seek professional advice before making any decisions based on the information provided on this blog.

One reply on “দার্জিলিং ভ্রমণ ||দার্জিলিং এর স্মৃতিলিপি (দ্বিতীয় খন্ড )”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *