গ্লেনারিজ থেকে বের হয়ে কিছু দোকানপাট ঘুরে টুকটাক কেনাকাটা করলাম |ফেরার পথে দার্জিলিং ক্লক টাওয়ার দেখলাম | বেশ ভালো লাগছিলো ,এতো পুরোনো ১টা জিনিস দেখে|তারপর উঁচু পাহাড় বেয়ে আমাদের গেস্ট হাউসে ফিরলাম |ঘরে ফিরে, ভীষণ হাঁপাচ্ছিলাম দুজনে |কিছুক্ষন পর ফ্রেশ হয়ে আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে বসলাম|জমিয়ে আড্ডা চলছিল আমাদের|
গ্লেনারিজ এর খাবার খাওয়ার পর ,আর দুপুরের খাবার নিয়ে ভাবতে হলোনা| বিকেলে একটু ঘুমিয়ে নিলাম|রাতে কি খাবো আলোচনা করে অর্ডার দিয়ে গেলাম|আর বললাম রাতে আমাদের অর্ডারটা হবে আপনার সর্বশেষ ডেলিভারি |এখানে সবাই “Early to bed ,early to rise” প্রবাদ খুব মেনে চলে|আমাদের মতো রাত জাগা লোকেরা ও মানতে বাধ্য|
সন্ধ্যার পর আবার হেঁটে হেঁটে বের হলাম রাতের দার্জিলিং শহরকে দেখতে|ইশ ! কি অসাধারণ দেখতে ! নিকষ কালো অন্ধকারে ,বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘরবাড়ির আলোকসজ্জাগুলু, কি অপূর্ব লাগছিলো দেখতে|চৌরাস্তাতে মোমো খেলাম| চা পান করলাম| এদিক ওদিক দেখতে দেখতে, রাত ৯টা বেজে গেলো|দোকান পাট বন্ধ হতে থাকলো | বাতিগুলো ও নিভে যেতে থাকলো |রাত ৯টা থেকে ৯:৩০টার মধ্যে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলো এবং লোকজন কমে যেতে থাকলো| আমরা ও গেস্ট হাউসের রাস্তা ধরলাম|উঁচু পাহাড় দিয়ে হেঁটে ফিরতে দেখলাম, স্থানীয় লোকেরা ঘুমিয়ে পড়েছে|নীরব নিঃস্তব্দ রাস্তা দিয়ে আমরা দুজনে হাত ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলাম|খুব ঠান্ডা লাগছিলো , সাথে এত শুনশান নীরবতা ভালো ও লাগছিলো|৯ :৪৫ বাজে আমরা ঘরে ফিরলাম এবং সাথে সাথে ই রাতের খাবার দিয়ে গেলো | ফ্রেশ হয়ে, প্রয়োজনীয় ফোন সেরে, রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরলাম|
পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো|ঝটপট উঠে পরলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে|আবহাওয়া মেঘাছন্ন হওয়ায় আজ আর দেখলাম না|মনটা খারাপ হয়ে গেলো|তা ও সকাল ৯টা পর্যন্ত, অনেকবার উঁকিঝুঁকি দিলাম দেখতে, কিন্তু প্রতিবার নিরাশ হতে হলো |চা, বিস্কিট খেয়ে সকাল ১০টা নাগাদ বেরিয়ে কুঙ্গা রেস্টুরেন্ট এ গেলাম |এখানে তিব্বতিয়ান খাবার পাওয়া যায় |আমরা মোমস,থুকপা আর চা খেয়েছি |খাবার খুব সুস্বাদু ছিল |
কুঙ্গাতে খাওয়া শেষ করে আমরা গেলাম মহাকাল মন্দিরে|দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে অবশেষে মন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছালাম|দেখলাম মহাকাল এবং বুদ্ধ একসাথে পূজিত হচ্ছেন|মহাকাল এর পাশে হিন্দু পুরোহিত আর বুদ্ধের পাশে বৌদ্ধিস্ট সন্ন্যাসী| হিন্দুরা হিন্দু পুরোহিতের কাছে যাচ্ছেন ,বৌদ্ধরা যাচ্ছেন বৌদ্ধিস্ট সন্ন্যাসীর কাছে|আমরা পুজো দিলাম ,ঘুরে দেখলাম, হিন্দু ধর্মের আরও অনেক দেবদেবী আছেন এই মন্দিরে |বেশ ভালো সময় কাটালাম মন্দিরে|
তারপর আমরা হাঁটতে শুরু করলাম দার্জিলিং স্টেশনের উদ্দেশ্যে|ইচ্ছে দার্জিলিং থেকে ঘুম স্টেশন ঘুরে আশা টয় ট্রেনে চড়ে|এই টয় ট্রেন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৯৯ সালে |অনলাইন এ টয় ট্রেন এর টিকিট অগ্রিম কাটা ছিল ১৫দিন আগে থেকে |দুপুর ২টা বাজে ছিল ট্রেন |আমরা ১ :৪৫ নাগাদ পৌঁছে গেলাম এবং ট্রেনে চড়ে বসলাম|এটা ছিল আমাদের প্রথম দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়েতে, রেল ভ্রমণ | আমার দারুন লাগছিলো|আসার আগে থেকেই খুব উত্তেজনা ছিল , টয় ট্রেন নিয়ে|আমাদের ট্রেনটা কয়লা থেকে উৎপাদিত তাপ দিয়ে চলবে |ভাবতেই কেমন ৮০বছর পিছনে চলে গেছি লাগলো | আর আমরা যে টয় ট্রেনটা তে চড়েছি শুনলাম সেটার ইঞ্জিন নাকি ব্রিটিশরা নিয়ে এসেছিলো |
ট্রেন ছাড়লো ঘুম স্টেশন এর উদ্দেশ্যে ঠিক ২টা বাজে|ধুঁয়া উড়িয়ে এঁকে বেঁকে ছুটে চললো পাহাড় বেয়ে |হর্নটা বেশিই একটু অন্যরকম |এরকম হর্ন আগে শুনা হয়নি|ট্রেনের ছাদের কাঁচ দিয়ে দেখলাম নীল আকাশ আর দুপাশের জানালার কাঁচ দিয়ে নানারকম ফুলের গাছ |অন্য আরও গাছ , ঘরবাড়ি দেখছিলাম |সবাই যেন ছুটে লুকিয়ে যাচ্ছিলো |কিছুক্ষন পর ট্রেনটা মিনিট দশেক থামলো , জল নেয়ার জন্য এবং জল নিয়ে আবার ছুটলো|ট্রেনটা কিন্তু অত বড় না |২টা কামড়া যাত্রীদের জন্য আর ১টা ড্রাইভারদের জন্য |ঠিক যেন খেলনা ট্রেন |একবার তো কিছু গাড়ি উঠে গেছিলো, ট্রেনের লাইনে |আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম |না,দেখি , ট্রেন থেমে গেলো , গাড়ি লাইনের উপর দেখে |গাড়িগুলো সরলো ,ট্রেন আবার ছুটলো |পরবর্তী বিরতি নিলো বাতাসিয়া লুপ এ |ট্রেন থেকে নামলাম ,একটু ঘুরে দেখলাম ও কিছু ছবি তুললাম |বেশ লাগছিলো জায়গাটা |তারপর গার্ড বাঁশি বাজালো , আমরাও ট্রেনে উঠে পড়লাম |এবার, আবার ট্রেন ছুটলো ঘুম স্টেশন এর দিকে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে|
ঘুম ভারতের সব থেকে উঁচু রেল স্টেশন |ঘুম স্টেশন এ পৌঁছালাম|ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম ,টয় ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরাচ্ছে |ওটা এমনি ট্রেনের মতোই |ইঞ্জিনটাকে আলাদা করে ,ইঞ্জিন ঘুরে এসে বিপরীত দিকে লেগে যায়| তারপর ঘুম যাদুঘর ঘুরতে গেলাম |ওখানে রেল এর অনেক আগের কলকব্জা,রেল লাইনের পাত ,টেলিফোন ,ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সার্টিফিকেট ইত্যাদি আছে |এতো পুরোনো জিনিস দেখতে ভালো লাগছিলো আমার|জাদুঘর দেখে, বেরিয়ে , স্টেশন এ এক কাপ চা খেলাম|মিনিট কুড়ি ঘুম স্টেশন এ কাটানোর পর, ফের ট্রেনে চড়ে বসলাম | এবার যাত্রা দার্জিলিং স্টেশন অভিমুখে|মিনিট পাঁচেক পর ট্রেন চলতে লাগলো |ঘন্টা খানেক এর মধ্যে ,পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং স্টেশন| স্টেশনে নেমে , হেঁটে রওয়ানা হলাম গেস্ট হাউসে |সূর্যাস্তের আগে ঘরে ফিরে এলাম|ঘরে এসে সূর্যাস্ত দেখলাম |একটা গাছ ,যেটাতে কোনো পাতা নেই|সেই গাছটার পেছন দিয়ে , সূর্যটা টুপ্ করে পাহাড়ে ডুব দেয় |এই ব্যাপারটা দেখতে ,মনে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে | এই মুহূর্তটা চিরঞ্জীব রুমে বসে, জানালা দিয়ে বেশ উপভোগ করলো |
সন্ধ্যার পর, চা খেয়ে, রাতের খাবার অর্ডার করে আমরা বের হলাম চৌরাস্তার দিকে|চৌরাস্তায় পৌঁছে ,বসলাম কিছুক্ষন|টুকিটাকি কেনাকাটা সেরে নিলাম|স্যুপ খেয়ে রাত ৯টা ৩০মিনিটে ঘরে ফিরলাম|ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষন আড্ডা দিলাম|তারপর , রাতের খাবার খেয়ে ঘুমোতে গেলাম |পরদিন ঘুম ভাঙলো ভোরে ,কাঞ্চনজংঘা দেখার লোভে ,কিন্তু আজও মেঘে ঢাকা |সকাল ৮টা পর্যন্ত অনেকবার উঁকিঝুঁকি দিলাম|যদিও প্রতিবার ই দেখতে না পেয়ে ব্যথিত হলাম|উঠে প্যাকিং ও সেরে নিয়েছিলাম কারণ আজ আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি মিরিখ|সকাল ৮ :৩০ মিনিট নাগাদ বেরিয়ে, প্রাতরাশ করে মিরিখ যাওয়ার গাড়ি নিয়ে গেস্ট হাউসে ফিরলাম|মিরিখ যাওয়ার গাড়িটা, আমরা ১দিন আগে ই বুক করে রেখেছিলাম|সকাল ১০ :৩০ মিনিটে, গেস্ট হাউসে থেকে চেক আউট করে বেরিয়ে পড়লাম,গন্তব্য মিরিখ|
দার্জিলিং শহর ছেড়ে আমরা যখন মিরিখ যাওয়ার রাস্তা ধরলাম ,রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্য্যে চোখ জুড়িয়ে গেলো|দুপাশে পাহাড় ঘেঁষে পাইন গাছের সারি আর উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা |গাড়ির চালক বলছিলো ,এখানে এমনো অনেক জায়গা আছে ,কখনোই রোদ লাগেনা |চলতে চলতে থামলাম আমরা ,নেপাল ভারত সীমান্তের কাছাকাছি একটা জায়গায় |আমরা ওখানে ওয়েই ওয়েই,আলুর লাল রঙের পাতলা ঝোল ভোজিয়া দিয়ে(নামটা ভুলে গেছি ) খেলাম|বেশ ভালো লাগলো জায়গাটা |
আমরা যে পাহাড়টাতে দাঁড়িয়েছিলাম , সেটা ভারত সীমান্তে |চোখের সামনে যে পাহাড়টা দাঁড়িয়েছিল সেটা নেপাল সীমান্তে|এক কথায় সব কিছু চোখ জুড়ানো সুন্দর|এখান থেকে বেরিয়ে গেলাম মিরিখ সৌরীনে রিসোর্ট এর উদ্দেশ্যে|রাস্তায় রেখে আসলাম সান্দাকফু যাওয়ার রাস্তা |সান্দাকফু মাত্র ২০ কি:মি: দূরে ছিল |সুখিয়া বাজারের লোকজন দেখলাম ভারী শীতের জামা গায়ে|চালক বললো, সান্দাকফু যেতে হলে ,সুখিয়া বাজার থেকে গাড়ি নিতে হবে|সান্দাকফুতে নাকি তখন বরফ পড়ছিলো |সান্দাকফু যাওয়ার সাহস আর হলোনা |কারণ, পরিকল্পনা ছিল না আগে থেকে আর ঠান্ডায় কাবু হয়ে তৎক্ষণাৎ উদ্দম নেয়ার সাহস হলোনা |সৌরীনে রিসোর্ট এর রাস্তায় চলতে থাকলাম|রিসোর্ট এ পৌঁছাতে ২টা বেজে গেলো |
One reply on “দার্জিলিং ভ্রমণ ||দার্জিলিং এর স্মৃতিলিপি (দ্বিতীয় খন্ড )”
Reading your article helped me a lot and I agree with you. But I still have some doubts, can you clarify for me? I’ll keep an eye out for your answers.